ইয়ুথ লিডার আশিক
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা উপজেলা খুলনার কয়রা। সৌন্দর্যের মায়াজালে ঘেরা সুন্দরবন সংলগ্ন পরিবারগুলোর গল্প কিন্তু এতটা সুন্দর না। জীবিকার তাগিদে গহীন অরণ্যে মাছ, মধু, কাঠ কাজ সংগ্রহ করতে হয় তাদের। বাঘের থাবায় অসংখ্য জেলে বাওয়ালীর মর্মান্তিক মৃত্যুও যেন হয়ে উঠেছে জীবনের অংশ। বাঘের থাবায় স্বামী হারানোদের সমাজ দুঃখ করে বলে ‘বাঘ বিধবা’। অধিকাংশ বাঘ বিধবাই শিক্ষা দক্ষতাতে যোজন যোজন পিছিয়ে। শিক্ষার অভাব, দক্ষতার অভাব তাদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়। দরিদ্রতা, ক্ষুধা মিলে পরিবারের হাল ধরার দায়িত্ব যেন বোঝা হয়ে দাঁড়ায় তাদের কাছে। এদের বিরাট একটা অংশই হচ্ছে আবার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আদিবাসী মুণ্ডা সম্প্রদায়ের। বাঘ বিধবা এবং মুণ্ডা সম্প্রদায়ের অনগ্রসরতা সবমিলে এই অঞ্চলের নারীরা বেশ পিছিয়েই আছে। বিধবা নারীদের হাহাকারে আফসোস করে না কে? কিন্তু কয়রার আশিক নামের এক তরুণ ভাবলেন কিছু একটা করা দরকার। যিনি এলাকায় পরিচিত হয়ে উঠেছেন ‘আশিক ভাই’ নামে। তার আশিক ভাই হয়ে ওঠার গল্প শুনতে ফেরত যেতে হবে ২০১৭ সালে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়দের ছাত্র আশিকুজ্জামান আশিক তখন ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে। এই অঞ্চলের অন্য দশজন মানুষের মতো বাঘ বিধবাদের সংগ্রামের গল্পটা তার জানা। কিন্তু তিনি শুধু জেনেই ক্ষ্যান্ত থাকতে চাইলেন না। কিছু একটা করতে চাইলেন। ঢাকায় টিউশনির টাকা থেকে কিছু টাকা জমানো ছিল। কয়রার বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের সঙ্গে দেখা করেন আশিক। জমানো টাকা থেকে ৩ জনকে সেলাইমেশিন কিনে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই ও শুভাকাক্সক্ষীদের সহায়তায় আরও ৭টি সেলাই মেশিন প্রদান করে মোট ১০ জন বাঘ বিধবাকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। ফেসবুকে সেই গল্প লেখা ও ছবি দেয়ার পর অসংখ্য লাইক, শত শত কমেন্ট এলো। ছড়িয়ে পড়ল খবর। এরই মধ্যে আরও দুইজন বাঘ বিধবাকে গরু পালন ও চালের কুঁড়ার ব্যবসা করার ব্যবস্থা করে দিলেন। এভাবে সকল বাঘ বিধবার পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন আশিক। ব্যতিক্রমী সামাজিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেলেন ‘এলজি প্রোগ্রাম এ্যাম্বাসেডর ২০১৮’ সঙ্গে অনুদান হিসেবে দিলেন ৪ লাখ টাকা। পুরোটাই ব্যয় করেন বাঘ বিধবাদের কল্যাণে। ৩০ জন বিধবা নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি। সেলাই মেশিনের সঙ্গে তাদের কাপড়ও কিনে দেয়া হয়। এভাবেই যাত্রা শুরু“হয় সামাজিক কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান আইসিডির। যাত্রার শুরুতে সুন্দরবনকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের বিকাশেও ‘কেওড়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র’ নামে একটি পর্যটন কেন্দ্রের দাবিতে সামাজিক আন্দোলন শুরু“করে সংগঠনটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দূরদূরান্ত থেকে অনেক পর্যটক এসে ভিড় করছেন। ঘুরে দেখছেন সুন্দরবন। পত্র-পত্রিকায়ও খবর প্রকাশিত হয়। স্থানীয়ভাবে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হবার পর বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মহাপরিচালক পর্যটন সম্ভাবনাময় স্থানটি পরিদর্শন করে গেছেন। এছাড়াও অত্র অঞ্চলে বসবাসরত পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আদিবাসী মুণ্ডা সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নেও কাজ করছে আইসিডি। এ সম্প্রদায়ের শিশুরা যাতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সে জন্য গড়ে তুলে ‘বিরসা মু-া প্রভাতী স্কুল’। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মু-া সম্প্রদায়ের স্বপ্নপুরুষ বিরসা মু-ার নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে বাসন্তী মু-া মাসিক ১ হাজার টাকা বেতনের চুক্তিতে মায়ের যতেœ প্রাথমিক পাঠ প্রস্তুত করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি মু-া ভাষা ও ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করা হয়। মু-াদের নিজস্ব ভাষায় রচিত গান ও ঐতিহ্যবাহী নাচের অনুশীলনও চলে স্কুলটিতে। প্রতিটি জাতির আছে স্বকীয়তা। স্বকীয়তা হারিয়ে গেলে জাতির অস্তিত্বই পড়বে হুমকির মুখে। সেই স্বকীয়তা যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্যই এই আয়োজন। মু-া শিশুদের জন্য শিক্ষাকে আনন্দময় করে তুলতে স্কুলব্যাগসহ সব উপকরণ সরবরাহ করছে আইসিডি। আড়াই শ’ বছর আগে ব্রিটিশরা ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্য ও রাঁচি অঞ্চল থেকে এ এলাকাকে মু-াদের নিয়ে আসে সুন্দরবনে আবাদ করে বসতি গড়ার জন্য, নীল চাষ করার জন্য। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে মু-াদের পেশা বৈচিত্র্যময় হতে থাকে। খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের বসবাসরত মু-াদের একটি বড় অংশ বসবাস করছে কয়রা উপজেলায়। বর্তমানে ১০০ মু-া নারীকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহুমুখী পাটপণ্য তৈরীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করছে আইসিডি। সুযোগ পেলে কয়রার আরও পাঁচশতাধিক বাঘ বিধবাকে স্বাবলম্বী করারও উদ্যোগ, পরিকল্পনা রয়েছে তার। মহৎ এই কার্যক্রমে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য বিনীত আহ্বান জানিয়েছেন আশিক। ব্যতিক্রমধর্মী সামাজিক কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেয়ায় সমাজ সেবায় এ বছর সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ লিডারশিপ এ্যাওয়ার্ড ২০১৯ ও ন্যাশনাল ইয়ুথ লিডারশিপ এ্যাওয়ার্ড ২০১৯ পুরস্কার পেয়েছেন আশিকুজ্জামান।
সোর্সঃ দৈনিক জনকণ্ঠ