উপকূলবাসীর সেবায় ‘মুন্ডাবন্ধু’ আশিকের নিরবচ্ছিন্ন আইসিডি

0 Comments
নাম আশিকুজ্জামান আশিক। আশিকের বাড়ি বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে সুন্দরবন কোলঘেঁষা খুলনা জেলার কয়রা উপজেলায়। আশিকের ইচ্ছা ও স্বপ্ন ছিল তার অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া, অসহায়, হতদারিদ্র মানুষ ও দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। এ কারণেই তিনি স্কুলজীবন থেকেই উন্নয়ন উদ্যোক্তা হওয়ার সংগ্রামে ছুটে চলতে শুরু করেন।

স্কুলজীবন থেকেই স্কাউটিংসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সেবামূলক কাজ শুরু করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেবামুলক কাজের পরিধি বাড়তে শুরে করে। কিন্তু এসব সংগঠনের মাধ্যমে তার প্রকৃত স্বপ্ন ও ইচ্ছা পূরণ না হওয়ায় নিজেই সংগঠন তৈরির উদ্যোগ নেন এলাকার যুবগোষ্ঠীকে নিয়ে। ধারাবাহিকতার প্রয়াসে সৃষ্টির অগ্রযাত্রার রূপ নেয় একটি স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন। একদল নিরবচ্ছিন্ন যুবক একই ছালাতলে এনে কল্যাণধর্মী কার্য বাস্তবায়ন ও মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগের উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ এই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়ে এবং সংগঠনের প্রাণশক্তি হলো অদম্য, প্রাণচঞ্চল যুবশক্তি এই বিষয়টিকে চিহ্নিত করে সামনে রেখে কিছুসংখ্যক যুবগোষ্ঠী সাংগঠনিক প্রজ্ঞা সমন্বিত করে ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে এলাকার সর্বস্তরের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের সাথে সংগতি রেখে উপকূলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও হতদরিদ্রদের ভাগ্যন্নোয়নে কাজ করার স্বপ্ন দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে চাকুরির পেছনে না ছুটে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট (আইসিডি) নামে একটি অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন আশিকুজ্জামান। প্রথমে ৩ জন বাঘবিধবার মাঝে সেলাই মেশিন প্রদানের মাধ্যমে তার কাজ শুরু। পরে আরো ৭ জনকে তিনি সেলাই মেশিন প্রদান করেন।

এভাবে তার কার্যক্রম শুরু হয়। পাশে দাঁড়ায় এলজি ইলেকট্রনিক বাংলাদেশ। এলজি বাংলাদেশের সহায়তায় কয়রার ৩০ জন বাঘবিধবাকে মাসব্যাপী সেলাই প্রশিক্ষণ, সেলাই মেশিন ও সিটকাপড় প্রদান করা হয়। এভাবে ছোট ছোট বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আইসিডি’র কর্ম পরিধি বাড়াতে থাকে।ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট ( আইসিডি) বাংলাদেশের দক্ষিণ – পশ্চিমাঞ্চল খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদের টেকসই কল্যাণে ব্যাপক ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আশিকের নেতৃত্বে আইসিডি কয়রার ৪৪ জন বাঘবিধবাকে স্বাবলম্বী করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঘবিধবা ও অস্বচ্ছল গৃহহীন ১৩ জনকে পুর্নবাসন করা, ৩১ জন বনজীবী মুন্ডা নারীকে নৌকা প্রদান করে তাদেরকে স্বাবলম্বী করা, ৯ জন দুস্থ ও বিধবা নারীকে সেলাই মেশিন ও নৌকা দিয়ে স্বাবলম্বী করা,মুন্ডা শিশুদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য ” বিরসা মুন্ডা প্রভাতী স্কুল” নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা,সরকারের পাশাপাশি কয়রায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আইসিডির মাধ্যমে ২০ টি সুপেয় পানির গভীর নলকূপ স্থাপন করা, দুই ঈদ ও পূজায় বাঘবিধবাদের উৎসব সামগ্রী, রমজানে বাঘবিধবাদের মাসব্যাপী ইফতার দেয়া সহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামুলক কার্যপরিচালনা করে আইসিডি।

৭ জন এতিমকে পড়াশোনার যাবতীয় খরচ বহন করছে সংগঠনটি। সম্প্রতি আইসিডি ২০ জন মুন্ডা তরুণ তরুণীকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে তথ্য প্রযুক্তি দক্ষ করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। চলমান শীত মৌসুমেও আইসিডি উপকূলের ২ হাজার শীতার্ত মানুষের হাতে কম্বল তুলে দিয়েছে। প্রাণঘাতী করোনা মহামারীর সময়ে মানুষ যখন দিশেহারা।ঠিক তখন ও অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের মত আইসিডি অসহায়ও দরিদ্র মানুষের কথা ভেবে সমাজের বিত্তশালী লোকদের কাছে হাত পেতে আর্থিক অনুদান এনে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন উপকূলবাসীর।এভাবে দেশের দুর্ভোগ ও ক্রান্তিলগ্নে ‘ আইসিডি’ সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করে একের পর এক কয়রার জনসাধারণের কাছে সুপরিচিত এবং প্রিয়মুখ হয়ে উঠেছে সর্বমহলে এই শিক্ষিত বেকার তরুণ আশিক।কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হতে থাকে আশিকের আইসিডি।

গত ২০ ডিসেম্বর ‘জয়বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ এর জন্য মনোনীত ৩০ টি সংগঠনের মধ্যে জায়গা করে নেয় আইসিডি।সম্প্রতি নেপালের রাজধানীর কাঠমান্ডুতে ‘গ্লোবাল ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ এ ভূষিত হয়েছে আইসিডির প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান। নেপালের উপরাষ্ট্রপতি নন্দ বাহাদুর পুন তাঁর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন। মুন্ডা সম্প্রদায়ের কল্যাণে অবদান রাখায় সম্প্রতি কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব অনিমেষ বিশ্বাসের উদ্যোগে আশিকুজ্জামানকে ‘মুন্ডাবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।এছাড়া ভিএসও- প্রথম আলো স্বেচ্ছাসেবা সম্মাননা ২০২০,আরটিভি – মনিমিক্স প্রেরণা পদক ২০২১,সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০১৯,এলজি অ্যাম্বাসেডর অ্যাওয়ার্ড ২০১৯, ২০২০,২০২১ কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ অর্জন করে আইসিডি।

স্থানীয়রা জনান, করোনা ভাইরাস মোকাবেলা প্রতিরোধসহ বিভিন্ন দুর্যোগকালীন সময়ে ‘আইসিডি’ যেসব ভূমিকা রাখছেন। সেগুলো আমাদের জন্য সমাজের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। ‘আইসিডি’ সংগঠনের মত আমরা যদি সবাই এই ভাবে মানুষের কল্যাণে কাজ করি তাহলে দেশটা সত্যিই সোনার বাংলায় পরিণত হবে। আমার আইসিডি’র প্রতিষ্ঠাতা আশিককে সেলুট জানাই।কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংঠনিক সম্পাদক এস এম বাহারুল ইসলাম বলেন, আইসিডি সংগঠনটি বিভিন্ন সময়ে সমাজের জন্য ইতিবাচক আয়োজন করে থাকে যা আমাদের খুব ভালো লাগে। মন্ডা সাম্প্রদায়,বাঘ বিধবাদের সার্বিক সহয়োগিতা পূর্ণবাসন, করোনা মহামারি, ঘূর্ণিঝঢ় ইয়াসে সে,বুলবুল ফনি তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। তারা সমাজের জন্য কাজ করছে। তাদের প্রতি আমার ভালবাসা থাকবে।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, আইসিডি সংগঠনটি আমার কাছে খুব পরিচিত। কারণ তারা উপকূল সেবায় ইতিবাচক পথে কাজ করেছে। তাদের পাশে কয়রা উপজেলা প্রশাসন সবসময় আছে এবং থাকবে।ইতি মধ্যে তাদের ভাল কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ আইসিডি’র প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান আশিককে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘মুন্ডাবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। জয় হোক আইসিডি’র।

আইসিডি’র প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান আশিক বলেন , মানুষের জন্য কিছু করাটাই আমাকে আনন্দ দেয় মনের তৃষ্ণাতৃষ্ণা মিটায়। আর আমি যে কাজগুলো করছি সেগুলো আমার একার পক্ষে সম্ভব হয়নি, আমাদের স্থানীয় সংসদ সদস্য মোঃ আক্তারুজ্জমান বাবু ভাইয়ের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা, পরামর্শ ও ভালবাসা আমার চলার পথকে সহজ করে । এছাড়াস্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এলজি ইলেকট্রনিক বাংলাদেশ, আদমজী ব্যাচ ৮৯ , নিড ফাউন্ডেশন, সুন্দরবন লায়ন্স ক্লাব খুলনা, ধ্রুবতারা ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেটস এ্যাসোসিয়েশন ( অর্কা) , পার্লস আলমিরাহ ইউএসএ, বাংলাদেশ ইউনিটি ফেডারেশন অব লস এঞ্জেলস (বাফলা)সহ বিভিন্ন ব্যক্তি, শুভাকাঙ্ক্ষী ও প্রতিষ্ঠান আইসিডিকে নিয়মিত সহযোগিতা করে আসছে।যাদের সহযোগিতা ও ভালবাসার ফলে সম্ভব হয়েছে। আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে যতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে ততোদিন মানুষের সেবায় নিজেকে নিবেদিত রাখবো, এটাই আমার ইচ্ছা।আশিক স্বপ্ন দেখে,উপকূলবর্তী উপজেলা গুলোতে তাঁর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়বে। সেই লক্ষ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে।

খুলনা-৬ সংসদ সদস্য মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন,আশিকের নেতৃত্বে আইসিডি দেশ ও দেশের বাইরে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সরকারের পাশাপাশি কয়রার বাঘবিধবা ও মুন্ডা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছে। তাদের এই কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আশিক আমাদের উপকূল অঞ্চলের গর্ব”। আমি আমার জায়গা থেকে তাদের ভাল কাজের জন্য সবসময় উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা করে আসছি। ভবিষ্যতেও আমি তাদের পাশে থাকব।
সোর্সঃ দৈনিক সকালের সময়

Leave a Comment

Your email address will not be published.